সারাদেশ

চা বিক্রেতা থেকে বিসিএস ক্যাডার

প্রবাসী এক স্বজন নিহতের খবরে গত ৩ আগষ্ট মরদেহ আনতে ঢাকায় যাচ্ছিলেন শরীয়তপুরের বেলায়েত হোসেন ইমরোজ। চলন্ত বাসে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার সামনে ফেসবুকে বিসিএসের ফল প্রকাশের খবর জানতে পারেন ইমরোজ। নির্দিষ্ট ওয়েব সাইটে গিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে দ্বিতীয় অবস্থানে নিজের রোল নাম্বার খুঁজে পেয়ে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ইমরোজ। সাথে সাথে একাধিক সূত্র থেকে বিষয়টি নিশ্চত হয়ে দুখের মাঝেও আনন্দের খবরটা প্রথমেই মোবাইলের মাধ্যমে মা, বাবাকে জানান তিনি।

ইমরোজের এমন সফলতার গল্পের শুরুটা মোটেও মসৃন ছিলনা তার জন্য। বাবার চায়ের দোকানে চা বিক্রি করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করতে হয়েছে তাকে। প্রাইমারী পাশ করার পর সংসারের প্রয়োজনে লেখাপরা বন্ধ করে বাবার সাথে কাজেও যোগ দিয়েছিলেন অদম্য এই শিক্ষার্থী। প্রাথমিক বৃত্তির ফল প্রকাশের পর পাল্টে যায় পরিবেশ। ইমরোজের বৃত্তি পাওয়ার খবরে মা হালিমা বেগম ছেলেকে লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা পোষণ করেণ। কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লেখাপরার খরচ আসবে কোথা থেকে? খবর পেয়ে এগিয়ে আসেন বিনোদপুর মৌলভীকান্দি দাখিল মাদরাসার শিক্ষকরা। বিনা খরচে ইমরোজের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।

সকালে বাবার চায়ের দেকানে চা বিক্রির পাশপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন ইমরোজ। স্কুলের সময় হলে বাবা শামছু তালুকদার দোকানে বসতেন ইমরোজ মাদরাসায় লেখাপড়া করতেন। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার বাবাকে সহায়তা করতে যোগ দিতেন চায়ের দোকানে। রাত ১০টা পর্যন্ত চা বিক্রির পাশাপাশি চালিয়ে যেতেন পড়ালেখা। অনেক সময় রাতে দোকানেই ঘুমাতে হতো তাকে। এভাবেই চলতে থাকে তার শিক্ষা জীবন। অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর বোনের বিয়ের পর আবারও অর্থের অভাবে সংসারের প্রয়োজনে লেখাপড়া বন্ধের যোগাড় হয়েছিল ইমরোজের। আবারও সামনে ছেলের লেখাপড়া করানোর সিদ্ধান্তের ইচ্ছা পোষণ করেন মা হালিমা।

অনেক কষ্টে পড়ালেখার খরচ মিটিয়ে ২০১২ সালে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হন ইমরোজ। নানান প্রতিকূলতার থাকা সত্বেও লেখাপড়া চালিয়ে নিতে ভর্তি হন শরীয়তপুর সরকারী কলেজে। বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার পথ বাইসাইকেল চালিয়ে কলেজে ক্লাস করতে হতো তাকে। পড়ালোখার খরচ যোগাতে অন্যেও বাড়িতে টিউশনি শুরু করেন ইমরোজ। ২০১৪ সালে এইচএসসিতেও শরীয়তপুর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হন ইমরোজ। ২০১৪-১৫ শিক্ষা বর্ষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৯ সালে ফিলোসফিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। এরপর শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। ৪০তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করলেও সফলতা আসেনি। আবার প্রস্তুতি নিয়ে ৪১তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন তিনি। গত ৩ আগষ্ট প্রকাশিত ফলাফলে শিক্ষা ক্যাডারে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হন ইমরোজ।

বেলায়েত হোসেন ইমরোজ জানান, ছেট বেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তার। লেখাপড়ার আগ্রহ থাকলেও আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। বাবার চায়ের দোকানে সময় দিতে হতো। বাবার কৃষি কাজেও সহযোগীতা করতে হয়েছে। এর মাঝে যে সময়টুকু পেতাম বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতাম। অনেক সময় লেখাপড়ার খরচ যোগাতে টিউশনি করতে হয়েছে। বিসিএস প্রস্তুতির সময় করোনায় সব বন্ধ ছিলো। এসময় আমার স্ত্রীর সবচেয়ে বেশি সহযোগীতা পেয়েছি। শত কষ্টের মাঝেও বাবা মা সবসময় আমার পাশে ধেকে আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত পিছিয়ে পরা মানুষের ভবিষৎ নির্মাণে কাজ করতে চাই। আমার মতো এমন কষ্ট করে যেন কাউকে লেখাপড়া করতে না হয় সে বিষয়ে সবসময় কাজ করতে চাই।

ইমরোজের মা হালিমা বেগম বলেন, টাকার অভাবে ওর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি ওর বাবারে বুঝাইছি, ওর মামারাও অনেক সহযোগীতা করছে। ও যখন ভার্সিটিতে পড়ে তখন ফোন দিয়া কইতাম বাবা আর কত লেখাপড়া করবি? আমার এত কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়। তোর বাবারও অনেক কষ্ট হইতাছে। তখন ছেলে কইতো মা, আর কয়টা দিন কষ্ট করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লার রহমতে আমার ছেলে বিসিএস পাশ করছে। আমাগো সকল কষ্ট ভুইলা গেছি।

ইমরোজের বাবা শমছু তালুকদার বলেন, আমিও দোকানে বসতাম আমার ছেলেও বসতো। যখন ওর স্কুলের সময় হতো তখন আমি দোকানে থাকতাম ও স্কুলে যাইতো। স্কুল শেষ করে বিকেলে আবার ও দোকানে বসতো। ছেলে অনেক কষ্ট কইরা লেখাপড়া করছে। আমার দোকানে চা বিক্রির ফাঁকে যখন সময় পাইতো বই লইয়া পইরা থাকতো। অনেক কষ্টে দিন কাটাইছি। অহন পোলার উছিলায় আল্লাহ চাইলে সুখের মুখ দেখমু। সবার কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই।

সবশেষ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন বড় সন্দীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্তমানে ইমরোজ ওই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত আছেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সানাউল্লাহ বলেন, ইমরোজ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই বিদ্যালয়েল পরিবেশ বদলে যেতে থাকে। শিক্ষার্থীদেও অনেক মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করান ইমরোজ। শত প্রতিকূলতার মাঝেও সে স্কুল ফাঁকি দিতো না। শিক্ষার্থীদের নিজের মতো করে পড়াতে ভালোবাসে সে।

বিনোদপুর মৌলভীকান্দি দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক আব্দুল হালিম বেপারী বলেন, ইমরোজের বাবা কৃষি কাজের পাশাপাশি চা বিক্রি কওে সংসার চালায়। বাবার চায়ের দোকানে কাজ করার পাশাপাশি লেখাপরা করতো সে। যদি ইমরোজ প্রাথমিকে বৃত্তি না পেতো তাহলে ওর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেতো। আমরা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকসহ ইমরোজকে ধরে নিয়ে আসি। ওকে আমাদের দিয়ে দেন। মাদরাসায় অর্থনৈতিক সহযোগীতাসহ সবধরনের সহযোগীতা আমরা ইমরোজকে করেছি। আজ সে শুধু বিনোদপুর বা শরীয়তপুর নয় সারা বাংলাদেশের গর্ব।

Back to top button