আওয়ামী লীগ

মনোনয়নবঞ্চিত মন্ত্রী-এমপি স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেই বহিষ্কার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন না আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় বাদ পড়া বর্তমান মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাদের কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের মুখে পড়তে পারেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন ঘোষণা আসছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, বিএনপিসহ অনেক দল অংশ না নেওয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক দেখা দেয়। এবার তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না আওয়ামী লীগ। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চায় দলটি। বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না এলে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও ভোটারদের অংশগ্রহণমূলক করতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে খানিকটা নমনীয় থাকবে আওয়ামী লীগ। ভোটকে উৎসবমুখর করে তুলতেই এবার এমন অবস্থান নিয়েছে দলটি। গত রোববার গণভবনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এমন আভাস দিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।

তবে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত এ সুযোগ পাচ্ছেন না সরকারের বর্তমান মন্ত্রী, এমপি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। ‘নৌকার’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাদের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে দলে চিরতরে নিষিদ্ধ হতে পারেন তারা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে এরই মধ্যে এমন আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল শহীদ ডা. মিলন দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিদ্রোহীদের বিষয়ে বলেন, ‘নতুন নতুন সময়ে নতুন নতুন কৌশলও দলকে গ্রহণ করতে হয়। এ সময়ে যে কৌশল দরকার, নেত্রী সে কৌশল ঠিক করেছেন। দলের অবস্থান অনুযায়ী, ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে দলীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন এবং দেন।’

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে অনেকটাই ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ যেন নির্বাচিত হতে না পারে’—আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যকে দলীয় প্রতীকের বিপক্ষে প্রার্থী হতে অনুপ্রেরণার জায়গা হিসেবে দেখছেন নৌকাবঞ্চিতরা। এরই মধ্যে বিভিন্ন সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেড় ডজনের বেশি নেতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। সরাসরি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা না দিলেও অনেকেই ‘এলাকাবাসীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়’ রয়েছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন। যাকে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আলামত বলে মনে করা হচ্ছে।

দলীয় মনোনয়ন নিয়ে টানা তিনবার নির্বাচিত হলেও এবার মনোনয়ন পাননি রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এনামুল হক। গতকাল সোমবার সকালে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি এলাকার মানুষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন জানিয়ে বলেন, ‘এ আসনকে আবার সন্ত্রাসের জনপদ হতে দেওয়া হবে না।’

তার এই বক্তব্যকে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছেন অনেকে। এ আসনে নৌকা পেয়েছেন আবুল কালাম আজাদ।

বর্তমান সংসদ সদস্য ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর বদলে চট্টগ্রাম-১২ আসনে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। তবে মাঠ ছাড়ছেন না সামশুল হকও। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়ার কথা ভাবছেন তিনি।

সিলেট-৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সারোয়ার হোসেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নেত্রীর নির্দেশনায় আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবো।’

ঢাকা-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান মোল্লা। ফেসবুকে এ ঘোষণা দিয়েছেন তার ভাই ও ডেমরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহফুজুর রহমান মোল্লা।

টানা ষষ্ঠবারের মতো রাজবাড়ী-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়তে চান রাজবাড়ী সদর উপজেলার টানা চারবারের চেয়ারম্যান ইমদাদুল হক বিশ্বাস। এজন্য সম্প্রতি তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

মানিকগঞ্জ-২ আসনে নৌকার মনোনয়ন চেয়ে পাননি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাহাবুদ্দিন আহমেদ চঞ্চল। তার বাবা সামসুদ্দিন আহমেদ এখানকার সাবেক সংসদ সদস্য। সাহাবুদ্দিন আহমেদ এখন স্বতন্ত্র হয়ে লড়বেন এখানে। এ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম।

যশোর-২ (চৌগাছা-ঝিকরগাছা) আসনে এবার প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন চিকিৎসক তৌহিদুজ্জামান তুহিন। তিনি আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদের জামাতা। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনির। তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ বিষয়ে স্থানীয় সবার মতামত জানতে চেয়েছেন।

ফরিদপুর-৪ আসনে আবারও নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ। এর আগে তিনি পরপর দুবার নৌকা নিয়ে হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) কাছে। বর্তমান সংসদ সদস্য ও যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নিক্সন এবারও নৌকা চেয়ে পাননি। তবে আগের মতোই স্বতন্ত্র হয়ে থাকছেন ভোটের লড়াইয়ে।

রংপুর-৬ আসনে আবারও নৌকা পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। নৌকা না পেয়ে এখান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। তিনি এরই মধ্যে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে নৌকা চেয়ে পাননি আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ইতোমধ্যে ফেসবুকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তিনি নির্বাচনী কাজ শুরু করে দিয়েছেন বলেও একাধিক পোস্টে জানানো হয়েছে।চাঁদপুর-৪ আসনে আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য শামসুল হক ভূঁইয়া। তিনি চাঁদুপর-৩ আসন থেকেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

চাঁদপুর-১ আসনে এবার নৌকা পেয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম মাহমুদ। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে নৌকা পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মো. শাহজাহান আলম। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মঈনউদ্দিন মঈন।

নেত্রকোনা-১ (দুর্গাপুর-কলমাকান্দা) আসনে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য মোশতাক আহমেদ রুহী। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য জালাল উদ্দিন তালুকদারের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ঝুমা তালুকদার। তিনি নৌকার মনোনয়ন চেয়ে পাননি। প্রার্থী হওয়ার জন্য দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন তিনি।

রাজশাহী-১ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের জন্য মনোনয়নপত্র তুলেছিলেন নায়িকা মাহিয়া মাহি। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চান। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসন থেকে নির্বাচনের জন্য তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম তুলেছেন মাহি। জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নামানুসারে ফরমে তার নাম লেখা হয়েছে শারমিন আক্তার নিপা। এ আসনে পুনরায় দলের টিকিট পেয়েছেন ওমর ফারুক চৌধুরী।

রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী আয়েশা আখতার ডালিয়াও। দলের অনুমতি সাপেক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম রাব্বানীও এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী আখতারুজ্জামান আক্তারও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন।

আওয়ামী লীগ নেতা আরিফুর রহমান ফরিদপুর-১ আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। আরিফুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াইয়ের অনুমতি দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কৃতজ্ঞতা। প্রধানমন্ত্রী বললেন, স্বতন্ত্র দাঁড়াতে কোনো অসুবিধা নেই। তৈরি থাকুন ফরিদপুর-১ আসনের জনগণ। আপনারাই শক্তি।’

জানা গেছে, এবার ৩০০ আসনে দলের মনোনয়ন চেয়েছেন ৩ হাজার ৩৬২ জন। প্রতি আসনে গড়ে নৌকার প্রার্থী হতে মনোনয়ন চান ১১ জন। একজন নৌকা পেলেও বাকি ১০ জন এখন কী করবেন—তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। আর তাতে বেশ জোরেশোরে বাতাস দিচ্ছে বিকল্প প্রার্থী (ডামি) রাখার দলীয় পরামর্শ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আনতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিদ্রোহী তকমা দেওয়া হবে না—আওয়ামী লীগের এমন নরম সুরে নৌকাবঞ্চিত অনেকেই ভোটের লড়াইয়ে নামতে পারেন। সেক্ষেত্রে অন্যরা ছাড় পেলেও বর্তমান মন্ত্রী, এমপি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে তারা আজীবনের জন্য বহিষ্কার হতে পারেন। খুব শিগগিরই এমন সিদ্ধান্ত দেওয়া হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট খবরগুলো

Back to top button