স্টাফ রিপোর্টারঃ
আমতলী উপজেলার কুকুয়া ইউনিয়নের দুই গ্রামের আধা কিলোমিটার এলাকা জুরে ঘন বসতিপূর্ন এবং তিন ফসলি জমির মধ্যে চার ইট ভাটা নির্মান করায় পরিবেশসহ ফসল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ওই দুই গ্রামের মানুষ। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভাটাগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উপরি ভাগের মাটি এতে কৃষি বিভাগ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তর নিচ্ছে না কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। দুই গ্রামের মধ্যে চারটি বিদ্যালয় থাকলেও তোয়াক্কা করছে না ভাটার মালিকরা। ভূক্তভোগী এলাকাবাসী এবং জনপ্রতিনিধিরা ইটভাটাগুলো বন্ধের দাবী জানিয়েছে।
কৃষি বিভাগ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, আমতলী উপজেলার কুকুয়া ইউনিয়নের রায়বালা ও খাকদান একটি ঘনবসতিপূর্ন এবং তিন ফসলি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এখানকার শত ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। গ্রাম দুটি পাশাপাশি অবস্থিত। এই গ্রাম দুটির ৫০০ মিটারের মধ্যে রায়বালা গ্রামের সড়কের পাশেই কৃষি জমির মধ্যে প্রভাবশালী নূর জামাল, সবুজ মৃধা ও মঈন ভূইয়া আল্লাহর দান ব্রিকস, মাহবুবুল আলম মৃধা এসএম ব্রিকস, হান্নান মৃধা বিবিসি ব্রিকসও শানু হাওলাদার খাকদান গ্রামে গড়ে তুলেছেন ফাইভস্টার ব্রিকস। এই এলাকার ভাটা থেকে ১০০ থেকে দেড়’শ ফুটের মধ্যে রয়েছে রায়বালা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, আকবরিয়া দাখিলী মাদরাসা, খাগদান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খাগদান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
আইনের তোয়াক্কা না করে এভাবে তিন ফসলি জমি ও চারটি বিদ্যালয় এবং গ্রামের ৫০০ মিটারের মধ্যে চারটি ইটভাটা নির্মান করায় গ্রাম দুটিতে দেখা দিয়েছে পরিবেশসহ ফসলের বিপর্যয়। বাড়ির আঙ্গিনা জুরে ফলের গাছ থাকলেও এখন আর নারিকেল, আম কাঠাল জামসহ কোন ফল আর আগের মত গাছে ধরছে না। আবার ভাটা সংলগ্ন অনেক বাড়ির গাছ মরে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। তিন ফসলি জমিতে এখন শুধু কোন রকম আমনের এক ফসল তুলেই সারা বছর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয় কৃষকদের। ভাটার ধূলা আর ধোয়ার আস্তরন জমিতে পরায় বোরো এবং রবি ফসল চাষ বন্ধ হয়ে গেছে এই গ্রাম দুটিতে। ওায়বালা ও খাকদান গ্রামে চারটি ইট ভাটার ইট ভাটার কারনে দেখা দিয়েছে সড়ক বিপর্যয়।
প্রতিদিন শতাধিক ট্রলিতে ইট পরিবহনের ফলে মহিষকাটা থেকে হাজার টাকার বাঁধ পর্যন্ত ৫কিলোমিটার সড়ক এখন চষা জমিতে পরিনত হয়েছে। কার্পেটিং উঠে সড়কে বড় বড় গর্ত হওয়ায় যানবাহনতো দুরের কথা এখন পায়ে হেটে মানুষের চলাচলও দায় হয়ে পড়েছে। ওবিবার সকালে রায়বালা ও খাকদান গ্রাম সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গ্রাম জুরে ইট ভাটার কর্মজঙ্গ। ভাটা চারটির ৫ থেকে ১০ ফুট দুরত্বেই রয়েছে আমনের আধাপাকা ধান ক্ষেত। ফসলের রুগ্ন চেহারা দেখে তাতে স্পষ্ট ইট ভাটার বিরুপ প্রভাবের ছাপ রয়েছে। আশপাশের গাছপালা ও ঘর বাড়িতে ধূলোবালির আস্তরন জমে পুরো হয়ে গেছে টিনের চালা আর গাছের পাতা। গ্রাম দুটিতে মানুষের বসবাস এখন তাদের নিকট নরক যন্ত্রনা হয়ে উঠছে বলে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গ্রাম দুটির ঘরে ঘরে শিশু নারী ও বয়স্ক মানুষের মধ্যে চর্মরোগ, হাপানি, ক্যান্সার, সর্দি কাশি লেগেই আছে। ইট ভাটার মালিকরা প্রভাশ শালী হওয়ায় অনেকেই ভয়ে কিছু বলতে পারছে না।
রায়বালা গ্রামের গ্রামের ষাটোর্ধ ছত্তার সিকদার বলেন, বাবা এহন কাশতে কাশতে মইর্যা যাই। দ্যাহেন আমনে এই গ্রামের মধ্যে আগে গাছ পালায় ভরা আছেলে এহন নাই। মোরা ছোড বেলা অইতে ৩ডা ফসল লইতাম এহন খালি কোন রহম আমন ধান পাই আরতা সব শ্যাষ অইয়া গেছে। ইট ক্ষ্যাতে মোগো সব খাইয় হালাইছে। আউষ আর রবি ফসল এহন আর অয় না। এই কথা মোরা ভয়েও কইতে পারি না। হ্যালে মামলা মোকদ্দমা দিয়া মোগো হয়রানি করার ভয় দেহায়। রায়বারা গ্রামের গৃহবধূ ফরিদা বেগম বলেন, মোরা ঘর বাড়িতে থাকতে পারি না। বিছানা পত্র ক্ষ্যাতা বালিশ ধুলায় সব ভইর্যা যায়। রাইতে ঠিক মত ঘুমাইতে পারি না। ঘুরা গাড়ায় খালি কাশে আর কাশে। খাকদান গ্রামের বাচ্চু হাওলাদার বলেন, আগে বাড়িতে গাছ পালায় ব্যামালা আম, জাম কাঠাল নারকেল অইত। এই গ্রামে ইট ভাটা অওয়ার পর এহন আর গাছে তেমন একটা ফল অয় না। গাছ পালা ধূলায় মইর্যা যাওন ধরছে। খাকদান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র সাকিব বলেন, ইট ভাটার কারনে রাস্তা ভাইঙ্গা যাওয়ায় আমরা ঠিকমত স্কুলে যাইতে পারি না।
রাস্তা দিয়া স্কুলে যাওয়ার সময় জামা কাপড়ে এবং বই খাতায় ধূলা পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া সর্দি কাশি আমাদের লেগেই থাকে। খাগদান গ্রামের ইউপি সদস্য মো. মাসুম বলেন, ইট ভঅটার কারনে আমাদের রাস্তাঘাট সব ধুসর;ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা এই ভাটা বন্ধের দাবী জানাই। রায়বালা গ্রামের ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন বলেন, রায়বালা গ্রামে তিন ফসলি জমি এবং গ্রাম ও বিদ্যালয়ের মধ্যে আইনের তোয়াক্কা না করে ৩টি ইট ভাটা নির্মান করায় আমাদের গাছপালা ফসলসহ সব ধ্বংস হয়ে গেছে। ভাটার ধুলায় আমি নিজেই এখন স্বাস কষ্টে ভূগছি।
আমরা এইসব ইট ভাটা বন্ধের দাবী জানাই। ওায়বালা গ্রামের বিবিসি ব্রিকস এর মালিক মো. হান্নান মৃধা বলেন, সব কিছু ম্যানেজ করেই আমরা এই গ্রামে ইট ভাটা চালিয়ে যাচ্ছি। খাগদান গ্রামের ফাইভ স্টার ব্রিকস এর মালিক শানু হাওলাদার ট্রলি এবং হামজায় ইট পরিবহনের কারনে রাস্তঘাট ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নের জবাবে বলেন, রাস্তাঘাট ধ্বংস হলে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। তার নিকট পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে অপরাগত প্রকাশ করেন। আল্লার দান ইট ভাটার মালিক নূরজামাল মৃধা সাংবাদিক আসার খবর শুনে ভাটা থেকে চলে যান। ফোন দিয়েও তাকে আর পাওয়া যায়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর বরগুনার সহকারী পরিচালক হায়াত মাহমুদ রকিব বলেন, আমি বরগুনায় নতুন যোগদান করেছি বিষয়টি আমি তদন্ত করে দেখবো।
আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইছা বলেন, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়া অবৈধ। এ বিষয়ে কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে প্রশাসনকে জানানো হবে। আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, কৃষি জমি এবং স্কুলের নিকট কোন ভাবেই ইটভাটা স্থপনের সুযোগ নেই। যদি সেরকম হয়ে থাকে তাহলে সরেজমিন তদন্ত করে তাদের লাইসেন্স বাতিলের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিস করা হবে। বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. শফিউল আলম বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।