আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিস মশার ধরন বদলেছে। এটি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে এবং মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দিন দিন বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘চলতি মাসে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। গবেষণার সময় আমরা এডিস মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতসহ কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করে একটি মডেল তৈরি করি। এটা স্পষ্ট যে আগামী দিনে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে।’
‘এই মুহূর্তে ডেঙ্গু হটস্পটগুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া এবং যেসব এলাকায় এরই মধ্যে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সেসব এলাকায় এডিস মশা দূর করতে ফগিং ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ৷
এডিস মশা যতদিন বেঁচে থাকবে তত দিন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়বে।এসব এলাকায় ফগিং মেশিনের মাধ্যমে মশা মারতে পারে। আর বেশি ছড়িয়ে পড়া এলাকা চিহ্নিত করতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঠিকানা ব্যবহার করতে পারে কর্তৃপক্ষ।
তিনি নগরবাসীকে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে এবং এডিস মশা যাতে তাদের বাসা-বাড়ি ও আঙিনায় না জমে তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
ঢাকার ৫৫টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে ৫৫টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানা গেছে। গত ১৮ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডে একটি জরিপ করে এতথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর (ডিজিএইচএস)।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪০টি ওয়ার্ড এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৮টি ওয়ার্ডে জরিপকালে ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ভবন, ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ বাড়ি এবং ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন যে ওয়ার্ডগুলো ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সেগুলো হলো: ২, ৩,৫,৬, ১১, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ ,২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৩৭ ও ৩৮। এসব ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে মিরপুর, পল্লবী, মাজার রোড, পীরেরবাগ, মনিপুর, শেওড়াপাড়া, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, খিলক্ষেত, কুড়িল, শাহারা, বনানী, গুলশান, বারিধারা, মহাখালী, রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, কারওয়ানবাজার, তেজতুরী বাজার, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, বায়তুল আমান, মগবাজার, ইস্কাটন ও বাড্ডা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো: ২,৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, ২২, ২৩, ২৬, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৪১, ৪৪, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১,৫৪, ৫৫ ও ৫৭ নম্বর। এসব ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে গোড়ান, মেরাদিয়া, বাসাবো, সবুজবাগ, মুগদা, মাদারটেক, ফকিরাপুল, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, পুরাতন রাজারবাঘ। পল্টন, বায়তুল মোকাররম, ধানমন্ডি, রায়েরবাজার, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, মিন্টো রোড, কাকরাইল, হাজারীবাগ, লালবাগ, আজিমপুর, পলাশী, বংশাল, সিদ্দিকীবাজার, শাখারিবাজার, ওয়ারী, সূত্রাপুর, মিল ব্যারাক, সৈয়দাবাড়ি, উত্তরপুর, সৈয়দাবাড়ি, উত্তরপাড়া, ধোলাইপাড়, গেন্ডারিয়া, জুরাইন ও কামরাঙ্গীরচর।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, এ বছর যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই আগে একবার বা দুবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তারা আবারও এ রোগে আক্রান্ত হলে তীব্রতা বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, তাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কি না তা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কিছু লোক দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আর এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা সেবা পেতে দেরি করলে জটিলতা বেড়ে যায়। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর পেছনে এটি আরেকটি কারণ।
এ ছাড়াও, এডিস মশার প্রকৃতির ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। এখন তারা সারা দিন ও রাতে মানুষকে কামড়ায়। বাইরের কৃত্রিম আলোতে সক্রিয় থাকতে পারে, যা ডেঙ্গু সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার বিরুদ্ধে অবিলম্বে কোনো কর্মসূচি না নিলে আগামী দিনে ভয়াবহ বিপর্যয় আসতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো কেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি- এমন প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার লেলিন বলেন, আমরা দেখছি সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। দ্বিতীয়ত, সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এ জন্য জনপ্রতিনিধি ও জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।
ডিজিএইচএসের ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডিএনসিসির ৪০টি ওয়ার্ড ও ডিএসসিসির ৫৮টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়িতে জরিপ চালানো হয়েছে। ওই জরিপে দেখা গেছে, ৫৪৯টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে; যা খুবই উদ্বেগজনক।
ডেঙ্গু ছড়ানোর পেছনে মানুষের অসচেতনতাকেও দায়ী করেন তিনি।
ডিজিএইচএস-এর মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘এ বছর বর্ষা দেরিতে শুরু হওয়ায় ডেঙ্গু মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জনবল সংকট কমাতে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি এবং রাজধানীর সব হাসপাতালেই ডেঙ্গুর চিকিৎসা চলছে।
ডিজিএইচএস-এর অতিরিক্ত পরিচালক ড. রাশেদা সুলতানা ইউএনবিকে বলেন, সব হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার খোলা হয়েছে এবং হাসপাতালগুলোতে একটি তথ্য ডেস্ক রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত শয্যা রয়েছে।
ডিএনসিসির ডেডিকেটেড ডেঙ্গু হাসপাতালে ৮০০ শয্যা রয়েছে যেখানে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ৬০০ শয্যা, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ১২০টি, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ১৯৫টি, শিশু হাসপাতালে ৪৪টি, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১২০টি, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৫০ শয্যা রয়েছে এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৭২টি শয্যা রয়েছে।
ডিজিএইচএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৮ জুলাই পর্যন্ত, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এটি চলতি বছর মশাবাহিত রোগে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৭ জনে।
একই সময় ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত আরো এক হাজার ৫৩৩ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ।
নতুন রোগীদের মধ্যে ৭৭৯ জনকে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং বাকিরা ঢাকর বাইরের হাসপাতালে ভর্তি।
রাজধানীতে তিন হাজার ৪৪৩ জনসহ মোট পাঁচ হাজার ৫৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী এখন সারাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এ পর্যন্ত, ডিজিএইচএস চলতি বছর ২৪ হাজার ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা এবং ১৮ হাজার ৩০৪ জন সুস্থ হওয়ার ঘটনা রেকর্ড করেছে।