আন্তর্জাতিকইউরোপ

বিভিন্ন দেশ ইউক্রেনকে নতুন যে অস্ত্র দিচ্ছে

রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো দেশটিকে আরো অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে।

ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশি সামরিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তালিকায় এর পরেই আছে ক্রমান্বয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), জার্মানি ও যুক্তরাজ্য।

ইউক্রেনকে কী পরিমাণ সামরিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে তার হিসাব রাখে কিয়েল ইন্সটিটিউট। তবে এই সংস্থায় তথ্য-উপাত্তের যে হিসাব রয়েছে, তা মে মাসের শেষ পর্যন্ত দেয়া দানের হিসাব। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য নতুন করে সামরিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে, যার পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র আরো নিশ্চিত করেছে, তারা ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা দিবে। যা একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ এবং যা নিয়ে ন্যাটো জোটের কিছু কিছু সদস্য দেশের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে।

ইউক্রেন ফ্রান্সের কাছ থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র পাবে। যা যুক্তরাজ্য থেকে সম্প্রতি পাঠানো স্টর্ম শ্যাডোস ক্ষেপণাস্ত্রের সমতুল্য।

ট্যাঙ্ক
ইউক্রেনকে ইতোমধ্যেই কয়েক ডজন ট্যাঙ্ক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। ইউক্রেন বলছে, তাদের এলাকাগুলো সুরক্ষার ও রুশ সৈন্যদের পিছু হটানোর জন্য এগুলো জরুরিভাবে প্রয়োজন।

আমেরিকা পাঠাচ্ছে তাদের ৩১টি অ্যাব্রামস ট্যাঙ্ক
যুক্তরাজ্য দিচ্ছে ১৪টি চ্যালেঞ্জার-টু ট্যাঙ্ক
জার্মানি পাঠাচ্ছে ১৪টি লিওপার্ড-টু ট্যাঙ্ক
স্পেন তাদের লিওপার্ড-টু ট্যাঙ্ক থেকে ছয়টি ইউক্রেনকে দিচ্ছে
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ লিওপার্ড-টু ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে থাকে। এই ট্যাঙ্কের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ তুলনামূলকভাবে সহজ বলে মনে করা হয়। এছাড়াও এই ট্যাঙ্কের অন্য পশ্চিমা ট্যাঙ্কেরগুলোর তুলনায় জ্বালানি খরচ কম।

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর প্রথম কয়েক মাস সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো ইউক্রেনকে পুরনো ট্যাঙ্ক সরবরাহ করাই সঠিক মনে করেছে। ওই সব ট্যাঙ্ক সাবেক ওয়ারস চুক্তির অধীনে ব্যবহার করা হয়েছিল।

ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী জানে কিভাবে ওগুলো চালাতে হয়, কিভাবে ওগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এছাড়াও ওই সব ট্যাঙ্কের যথেষ্ট যন্ত্রাংশ ইউক্রেনের কাছে ছিল।

আধুনিক পশ্চিমা ট্যাঙ্কগুলো ব্যবহারের দিক দিয়ে অনেক বেশি জটিল ও দেখভাল করা কঠিন।

রাশিয়ার অবস্থানের ওপর ইউক্রেনের সাম্প্রতিক হামলার একটি ফুটেজ থেকে দেখা যাচ্ছে, অন্তত একটি লিওপার্ড ট্যাঙ্ক এবং বেশ কয়েকটি ব্র্যাডলি ট্যাঙ্ক ইউক্রেন বাহিনী ইতোমধ্যেই যুদ্ধে ব্যবহার করেছে।

ন্যাটো জোটের মধ্যে যুক্তরাজ্য এ ব্যাপারে প্রথম পথ দেখিয়ে তাদের প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্ক চ্যালেঞ্জার-টু ইউক্রেনকে দেয়ার প্রস্তাব করেছে।

চ্যালেঞ্জার-টু ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয় ১৯৯০-এর দশকে। কিন্তু ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে অন্য যেসব ট্যাঙ্ক আছে সেগুলোর তুলনায় চ্যালেঞ্জার-টু অনেক বেশি উন্নত ও আধুনিক।

রুশ আক্রমণের আগে ইউক্রেন ওয়ারস প্যাক্টের অধীনে ডিজাইন করা টি-সেভেন্টিটু ট্যাঙ্ক ব্যবহার করত। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির পর পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র ও ছোট ছোট আরো কয়েকটি দেশ থেকে ইউক্রেন দুই শতাধিক টি-৭২ ট্যাঙ্ক পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে ৩১টি অ্যাব্রামস ট্যাঙ্ক পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্যাঙ্কগুলোকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ট্যাঙ্ক’ বলে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, ইউক্রেনিয় সৈন্যরা যেন অবিলম্বে ওই ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতে পারে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের এখনই প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করবে। কিন্তু কবে নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ওই ট্যাঙ্ক সরবরাহ করবে তা এখনো অস্পষ্টই রয়ে গেছে।

ইউক্রেনের সৈন্যরা গ্রীষ্ম মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই অ্যাব্রামস ট্যাঙ্ক ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ শেষ করবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ওই সময় নাগাদ ট্যাঙ্কগুলো ইউক্রেনে পৌঁছবে এমন মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।

সাঁজোয়া যুদ্ধ যান
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের ব্যাপক সামরিক সরঞ্জাম, সেগুলো সম্বন্বিতভাবে মোতায়েন করা এবং সেগুলো কার্যকর রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সবরকম রসদ ও ব্যবস্থা তৈরি রাখা।

যেসব সাঁজোয়া যান ইউক্রেনকে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো স্ট্রাইকার যান। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে যে তারা ইউক্রেনে ৯০টি স্ট্রাইকার সাঁজোয়া যান পাঠাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অন্য আরো যেসব লড়াইয়ের যানবাহন পাঠিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ব্র্যাডলি পদাতিক যুদ্ধ যান। যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ইরাক যুদ্ধে ওই সাঁজেয়া যান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিল।

বিমান প্রতিরক্ষা
ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র আরো ঘোষণা করে, তারা ইউক্রেনে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পাঠাচ্ছে।

তারপর জার্মানি আর নেদারল্যান্ডসও একই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর কথা ঘোষণা করে।

অত্যন্ত অত্যাধুনিক এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লা ৬০ মাইল বা ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে তা নির্ভর করে কী ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ইউক্রেনিয় সৈন্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এবং তা সম্ভবত দেয়া হবে জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেনা ঘাঁটি ব্যবহার করে।

তবে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। একটি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা চালু রাখতে খরচ পড়ে প্রায় তিন মিলিয়ন ডলার।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেন রুশ আক্রমণ প্রতিহত করতে সোভিয়েত যুগের ভূমি থেকে আকাশে ব্যবহারযোগ্য এস-৩০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থ ব্যবহার করছে।

লড়াই শুরু হওয়ার আগে ইউক্রেনের কাছে প্রায় ২৫০টি এস-৩০০ ছিল এবং অন্য সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো থেকে একই ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নিয়ে মজুদ রাখার উদ্যোগ নিয়েছিল ইউক্রেন। এমন বেশ কিছু সরঞ্জাম ইউক্রেন সংগ্রহ করে স্লোভাকিয়া থেকে।

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ন্যাশানাল অ্যাডভান্সড সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম (নাসাম) ক্ষেপণাস্ত্রও দিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ওই নাসামগুলো ইউক্রেনে পৌঁছেছে নভেম্বর মাসে।

পাশাপাশি, ব্রিটেনও ইউক্রেনকে বেশ কয়েক ধরনের বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে স্টারস্ট্রিক। যা ব্যবস্থা ব্যবহার করে কাছাকাছি পাল্লার মধ্যে নিচুতে থাকা বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা যায়।

জার্মানিও ইউক্রেনকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে আইরিস-টি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যার সাহায্যে ২০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত ধেয়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্রে আঘাত হানা যায়।

দূর পাল্লার কামান
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে দূর-পাল্লার যেসব রকেট লঞ্চার পাঠিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে দ্রুত গতিতে কামান দাগার উপযোগী রকেট ব্যবস্থা বা হিমার্স। একই ধরনের রকেট লঞ্চার পাঠিয়েছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ।

ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে রুশ সৈন্যকে পেছু হটতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে ইউক্রেন বাহিনীর সাফল্যের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে হিমার্স। বিশেষ করে নভেম্বর মাসে খেরসনের লড়াইয়ে।

হিমার্স ব্যবস্থা অনেক বেশি নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং রুশরা যে স্মের্চ ব্যবস্থা ব্যবহার করছে তার থেকে আরো দীর্ঘ পাল্লায় কাজ করতে সক্ষম হিমার্স।

হাউয়িৎজার
রুশ হামলা শুরুর এবং এরপর কিয়েভ থেকে রাশিয়ার পশ্চাদপসরণের পরের কয়েক মাস, যুদ্ধ মুলত কেন্দ্রীভূত ছিল দেশটির পূর্বাঞ্চলে। ওই সময় ইউক্রেনের জন্য কামানের চাহিদা ছিল খুবই বেশি।

যেসব দেশ তখন ইউক্রেনে এম-৭৭৭ হাউয়িৎজার কামান এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে তাদের মধ্যে ছিল অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র।

রাশিয়া যে গিয়াটসিন্ট-বি হাউয়িৎজার ব্যবহার করে, এম-৭৭৭-এর পাল্লা ঠিক একইরকম। তবে রাশিয়ার ডি-৩০ বন্দুকের নল থেকে এম-৭৭৭-এর বন্দুক অনেক বেশি লম্বা।

ন্যাটো সদস্য দেশগুলো বলছে, তারা কামানের গোলার সরবরাহ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে। কারণ ইউক্রেন গোলা ব্যবহার করছে অনেক দ্রুতগতিতে এবং নতুন সরবরাহ পৌঁছানোর অনেক আগেই তাদের গোলা ফুরিয়ে যাচ্ছে।

তারা তাদের দেশের ভেতর স্থানীয় গোলা প্রস্তুতকারকদের উৎপাদন আরো বাড়াতে বলছে।

ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র
হাজার হাজার এন-ল অস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করা হয়েছে, যেগুলো থেকে একটা মাত্র গুলি ছুঁড়ে ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা যায়।

রাশিয়ান হামলা শুরুর পরের দিন ও ঘণ্টাগুলোয় কিয়েভে রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ওই অস্ত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল।

ড্রোন
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত ড্রোন ব্যবহার হয়েছে খুবই বেশি। বহু ক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহার হয়েছে নজরদারির কাজে, লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে এবং ভারি সরঞ্জাম তোলার কাজে।

তুরস্ক ইউক্রেনের কাছে বায়রাকটার টিবিটু সশস্ত্র ড্রোন বিক্রি করেছে। ইউক্রেনকে সাহায্য করতে জনগণের দেয়া অর্থে তুরস্কের ড্রোন প্রস্তুতকারকরা ড্রোন তৈরি করে সেগুলো ইউক্রেনকে দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বায়রাকটার টিবিটু ড্রোন অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। এই ড্রোন প্রায় ২৫ হাজার ফুট উঁচু পর্যন্ত উড়ে নিচে নেমে এসে রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর লেজার নিয়ন্ত্রিত বোমা দিয়ে আঘাত হেনেছে।

যুদ্ধ বিমান কি দেয়া হয়েছে?
ইউক্রেনের যুদ্ধ বিমান পাঠানোর অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্র বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে এ যাবত তারা অন্য সামরিক সাহায্য পাঠানোর বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে।

মে মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক যুদ্ধ জেট বিমান দিবে। যার মধ্যে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান। যুক্তরাষ্ট্রে ইউক্রেনের পাইলটদের ওেই বিমান চালানোর প্রশিক্ষণও দিবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওই ঘোষণা অন্য দেশকেও তাদের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ইউক্রেনে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো তাদের থেকে থেকে যে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান কিনেছিল সেগুলো অন্য দেশে আবার রফতানি করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদনের প্রয়োজন।

ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও ডেনমার্ক ওই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বলেছে তারাও সমর্থন জোগাবে।

সংশ্লিষ্ট খবরগুলো

Back to top button