যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের জলাভূমিতে বার্মিজ পাইথন জাতীয় অজগর সাপের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে এক দশক আগেই সেখানে এই সাপ মারার জন্য শিকারীদের উৎসাহিত করতে বছরে একবার একটি পাইথন নিধন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নিয়ে এই বিরাটকায় সাপ মারতে আসেন হাজার হাজার লোক। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, তার বাইরের নানা দেশ থেকেও । তাদেরই নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প এই রিপোর্টে।
ফ্লোরিডার নেপলসের বাসিন্দা জেক ওয়ালেরি। ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এব ২২ বছর বয়স্ক তরুণ চলতি বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে পরিকল্পনা করেছেন-তিনি সাপ মারবেন।
স্থানীয় লোক হওয়ায় তিনি এই পাইথন সমস্যার কথা আগে থেকেই জানতেন। আর টেলিভিশনের মাধ্যমে তিনি জেনেছেন ‘ফ্লোরিডা পাইথন চ্যালেঞ্জের’ কথা, সেখানে দেখেছেন কিভাবে পেশাদার সাপ শিকারীরা ১৯-২০ ফুট লম্বা বার্মিজ অজগর শিকার করছে। তখন থেকেই তার মাথায় ঢোকে এই সাপ শিকারী হবার ভাবনা। গত দু’বছর ধরে তিনি নিজেই সাপ শিকার করছেন।
এখন তার লক্ষ্য ফ্লোরিডা পাইথন চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হওয়া। গত বছরও তিনি এ প্রতিযোগিতায় ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তখনও সাপ শিকারের ক্ষেত্রে তার র্যাংকিং যথেষ্ট ভালো ছিল না। তাই সুযোগ পাননি। পেয়েছেন এবার।
জেক বলেন, ‘এ বছর আমি এই শিরোপা জিততে চাই।’
কেন এই সাপ-নিধন প্রতিযোগিতা?
বার্মিজ পাইথন নামের এই অজগরের আবাস ফ্লোরিডার দক্ষিণাঞ্চলের ‘এভারগ্লেড’ নামে জলজ তৃণভূমিতে।
বিশাল আকারের এই সাপ পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ১৯ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা এবং ওজনে ৯০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। একটা টেলিফোনের খাম্বার মতো চওড়া বার্মিজ পাইথন একটা আস্ত ঘড়িয়াল বা এ্যালিগেটর পর্যন্ত গিলে ফেলতে পারে বলে শোনা যায়। এভারগ্লেড অঞ্চলে এই সাপের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে তাদের খিদে মেটাতে অনেক প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির মুখে।
প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই এভারগ্লেড নামের জায়গাটিকে বলা যায় জলজ ঘাসের নদী যাতে বহু ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী বাস করে। এই এভারগ্লেডকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সাবট্রপিক্যাল বনভূমি, আর পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অঞ্চল।
এখানকার র্যাকুন, খরগোশ এবং পোসুমের মতো প্রাণীর ৯০ শতাংশের বেশি এই বার্মিজ পাইথনের পেটে গেছে বা প্রায় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে । নামেই বোঝা যাচ্ছে এই বার্মিজ পাইথন এখানকার স্থানীয় সাপ নয়।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সাপ পোষা যখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তখন এই সাপ ফ্লোরিডায় আসে। ক্রমান্বয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার বনভূমিতে এবং হুমকি হয়ে ওঠে স্থানীয় প্রাণীর জন্য।
স্থানীয় প্রাণী সংরক্ষণবিদরা বলছেন, এই বার্মিজ পাইথন বিশেষ করে এভারগ্লেড এলাকার প্রাণীবৈচিত্রের গুরুতর ক্ষতি করেছে এবং এর সংখ্যা কমানোর জন্যই এই বার্ষিক অজগর-নিধন প্রতিযোগিতা দরকার।
হরিণ ও ঘড়িয়াল পর্যন্ত খেতে পারে এই অজগর
এই বার্মিজ পাইথন ঘাস, জলাভূমি ও গাছে লুকিয়ে থাকে। এরা খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে, পানির নিচে থাকতে পারে ৩০ মিনিট পর্যন্ত।
এদের খাবারের তালিকায় পাখী, ইঁদুরজাতীয় প্রাণী, খরগোশ, আর অন্য সরীসৃপ তো আছেই-এমনকি হরিণ ও ঘড়িয়াল (এ্যালিগেটর) পর্যন্ত খেয়ে ফেলতে পারে এই সাপ।
ফ্লোরিডার প্রকৃতিতে এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই যেই অজগর খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখবে ফলে এদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে ব্যাপক হারে। তাছাড়া এরা কিছু ক্ষতিকর পরজীবী শরীরে বহন করে যা এখানকার অন্য প্রজাতির সাপের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।
যত খুশি অজগর নিধনের অনুমতি
মার্কিন ফেডারেল কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে বার্মিজ পাইথন আমদানি নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। এর এক বছর পর শুরু হয় পাইথন চ্যালেঞ্জ নামে এই সাপ মারার প্রতিযোগিতা।
এখন এ রাজ্যে ‘ওপেন সিজন’ ঘোষণা করা হয়েছে যার মানে হলো বছরের যেকোনো সময় পাইথন নিধন করা যাবে। এ জন্য কোনো পারমিট লাগবে না। একজন কতগুলো পাইথন মারতে পারবে তার ওপরও কোনো বিধিনিষেধ নেই।
কিছু প্রাণী অধিকার সংগঠন অবশ্য এর সমালোচনা করেছে। তারা চায় মানবিক উপায়ে এবং শুধু পেশাদার শিকারীদের দিয়ে এর সংখ্যা কমানো হোক। তবে এই নিধন-প্রক্রিয়ার কি ফল হচ্ছে তাও এখন খুব স্পষ্ট নয়।
জেক ওয়ালেরির সাপ ধরা
চলতি বছর প্রতিযোগিতা শুরুর এক মাসে আগে থেকেই ওয়ালেরি এই জলাভূমিতে সাপ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
তার সাথে আছে বুক-সমান পানির মধ্যে দিয়ে চলার সরঞ্জাম, সাপের মুখ আটকানোর জন্য টেপ, স্থানীয় বিষাক্ত সাপ তাড়ানোর জন্য লাঠি।
অভ্যস্ত না হলে সাপের মাথাটা ঠিকমত হাতে ধরা মুশকিল, বলছিলেন জেক। সাপের মাথাটা ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি, যাতে এটা কামড়াতে না পারে বা আপনাকে পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করতে না পারে।
‘আপনি যদি ইতস্তত করেন তাহলে আপনার হাতটা পড়বে সাপের মুখের ঠিক সামনে আর তখনই সাপ আপনাকে কামড় দেবে।’ সাথে ছিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বন্ধু-যারা এসেছিলেন ওহাইও আর ইলিনয় থেকে।
তাদের জংলী সাপ ধরার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৯ ফুট লম্বা একটি বিরাট পাইথন পেয়ে গেলেন।
‘সাপটা রাস্তার ওপর উঠে এলো, আমি দেখলাম ওটা কত বিশাল। বুঝতে পারলাম আমরা একটা বড় রকমের লড়াইয়ে নামতে যাচ্ছি’ – বলেন জেক ওয়ালেরি।
সাপটা ধরার পর এটাকে রাজ্যের ইতিহাসের বৃহত্তম বার্মিজ পাইথন বলে ঘোষণা করা হলো।
‘আমি মনে করেছিলাম ওটা একটা গাছ’
চলতি বছর তৃতীয়বারের মতো পাইথন ধরতে এসেছেন ব্র্যান্ডন কল।
তিনি শ্রবণ-প্রতিবন্ধী একজন স্কুল শিক্ষক। ২০২১ সালে তিনি সবচেয়ে বড় পাইথন ধরে ১৫০০ ডলার পুরস্কার জিতেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘ওই সাপটা এত বড় ছিল যে আমি মনে করেছিলাম ওটা একটা গাছ।’ এ বছর তিনি তার সাথে আরেকজন বিজ্ঞান শিক্ষককে নিয়ে এসেছেন যিনিও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী।
তাদের শিকার করা সাপগুলো কখনো কখনো তার স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্র্যান্ডনের ছাত্ররাও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী। কখনো কখনো জীববিজ্ঞানের ক্লাসে সেই সাপের ব্যবচ্ছেদও করা হয়।
তিনি বলেন, শ্রবণশক্তি না থাকায় তার চোখের ক্ষমতা অনেক জোরালো যা লুকিয়ে থাকা চিহ্নিত করতে সহায়ক হয়।
এতে কতটা ফল পাওয়া যাচ্ছে
ফ্লোরিডার এভারগ্লেড বনভূমিতে এই বার্মিজ পাইথন সাপের সংখ্যা কত তা সঠিকভাবে জানা নেই-তাই এই নিধন-প্রক্রিয়ার কি ফল হচ্ছে তাও এখন খুব স্পষ্ট নয়।
রাজ্যের সংরক্ষণ কর্মকর্তা ও প্রতিযোগিতার আয়োজকদের একজন কার্লি সেগেলসন বলেন, তারা এভাবে দেখেন যে একটি বার্মিজ পাইথন মারা হলেও তা একটি বিজয়।
পাইথন বেশির ভাগ সময়ই স্থির হয়ে শুয়ে থাকে । খাওয়ার উপযোগী প্রাণী কাছে না আসা পর্যন্ত এটা প্রায় কোনো নড়াচড়া করে না। এমনভাবে তা পরিবেশের সাথে মিশে থাকে যে তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া খুব কঠিন।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মেলিসা মিলার বলেন, ‘কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যদি ১০০টি পাইথন থাকে এবং আপনি কাউকে তাদের ধরতে পাঠান, তারা হয়তো পাইথন পাবে মাত্র একটি। ফ্লোরিডায় পাইথন নিধন শুরু হবার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার পাইথন মারা হয়েছে।
এর মধ্যে প্রতিযোগিতার সময় মারা পড়েছে খুবই সামান্য। কারণ এভারগ্লেডের ৯৭ শতাংশ এলাকাই দুর্গম এবং নৌকা ও হেলিকপ্টারের মতো বিশেষ ধরনের সরঞ্জাম ছাড়া প্রতিযোগীরা গভীর বনে ঢুকতে পারে না।
মানবিক উপায়ে হত্যা
প্রতিযোগীদের ২৫ ডলার দিতে হয়, ৩০ মিনিটের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ করতে হয়। এখানে তাদের শেখানো হয় পাইথন কিভাবে চিহ্নিত করতে হবে এবং কিভাবে তাদের দ্রুত ও মানবিক উপায়ে হত্যা করা যায়।
সাধারণত সাপটিকে ওজন করার পর তার মাথায় ছুরিকাঘাত করে স্পাইনাল কর্ড কেটে দিয়ে এবং মস্তিষ্ক ধ্বংস করে তাদের মারা হয়। গুলি করেও মারা যায়, তবে তা শুধু বিশেষ কিছু এলাকায়।
এছাড়া এখন একটি কর্মসূচির অধীনে পুরুষ পাইথনের দেহে রেডিও সিগন্যাল যন্ত্র বসিয়ে দেয়া হচ্ছে যাতে তাকে অনুসরণ করে স্ত্রীজাতীয় সাপ কোথায় আছে তা চিহ্নিত করা যায়। এদের বলা হয় স্কাউট পাইথন। একটি স্ত্রী পাইথন বছরে প্রায় ১০০টি ডিম দিয়ে থাকে।
প্রতিযোগীদের জন্য এই স্কাউট সাপ হত্যা করা নিষিদ্ধ। সাপটি মারার পর তা বিক্রি করা যায় বা নিজের কাছেও রাখা যায়। প্রতিযোগীদের নিরুৎসাহিত করা হয় যাতে তারা পাইথনের মাংস না খান কারণ তাদের দেহে উচ্চ মাত্রায় পারদের উপস্থিতি আছে।
তবে কিছু শিকারী এগুলো উপেক্ষা করে ‘পাইথন জার্কি’ বা সাপের ডিমের কুকির মতো খাবার বানিয়ে থাকেন। ফ্লোরিডায় গত ৪০ বছর ধরে বাস করছেন মার্সিয়া কার্লসন পার্ক। তিনি এখন সারা বছর ধরেই পাইথন শিকার করেন।
তিনি বলেন, এখন মহিলা পাইথন শিকারীর সংখ্যা আগের চাইতে বেড়েছে।
মিসেস পার্ক বলেন, এই পাইথনের জন্য ফ্লোরিডার জলাভূমিতে কোনো বন্যপ্রাণী অবশিষ্ট নেই।
তিনি বলেন, ‘আপনি একটা খরগোশ বা র্যাকুন খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন-পাবেন না। পাইথন সব খেয়ে ফেলেছে। তারা ঘড়িয়ালও খায়। আমরা একটা ১৫ ফুট পাইথনের পেটে পাঁচফুট লম্বা এ্যালিগেটর পেয়েছি।’
এই পাইথন চ্যালেঞ্জের জনপ্রিয়তা এখন ক্রমাগত বাড়ছে, আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা নিয়ে একটি টিভি অনুষ্ঠানও বানানো হয়েছে।
অনুষ্ঠানটির নির্মাতাদের একজন লুক ডেল ট্রেডিচি বলেন, কিছু দর্শক হয়তো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রাণীহত্যার প্রতিযোগিতা দেখে মর্মাহত হতে পারেন। ‘কিন্তু যখন তারা বোঝেন যে এই বার্মিজ পাইথন কিভাবে এখানকার পরিবেশের ক্ষতি করছে তখন ব্যাপারটা অনেক জটিল হয়ে দাঁড়ায়।