বরিশাল

অভিযান-১০ লঞ্চ ট্র্যাজেডি: এখনো ১৬ জনের পরিচয় মেলেনি

অভিযান ১০ লঞ্চ ট্র্যাজেডির এক বছর পূর্ণ হলো আজ। এই দিনেই ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে চলন্ত নৌ-যানটি শতশত যাত্রী নিয়ে পুড়ে যায় আগুনে। সুগন্ধা নদীর বাতাসে ছড়িয়ে পরে পোড়া লাশের গন্ধ। শোকের ছায়া নেমে আসে বরগুনা সহ সারা বাংলাদেশ জুড়ে। আগুনে দগ্ধ হয়ে নারী-শিশুসহ ৪৭ জন মানুষের প্রাণহানি হয়। দগ্ধ হয় আরো অসংখ্য মানুষ।

লঞ্চের চার মালিক, দুই ইনচার্জ মাস্টার, সুকানি, দুই ইঞ্জিনচালক ও চালকের সহকারীকে সরাসরি দায়ী করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন নৌ-মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে ইঞ্জিন ত্রুটিপূর্ণ থাকার পরও লঞ্চের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় কারণে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সদরঘাটের সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টও এবং মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স সংক্রান্ত বিধিবিধান লঙ্ঘনের জন্য ইঞ্জিন পরিবর্তন করা ডকইয়ার্ডের মালিককেও দায়ী করা হয়েছিল।

চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি বুধবার এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌ আদালতের মামলায় কারাগারে থাকা সাত আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন নৌ আদালতের বিচারক স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জয়নাব বেগম এ আদেশ দেন।

মামলার আসামিরা হচ্ছেন-  লঞ্চটির স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স আল আরাফ অ্যান্ড কোম্পানির চার মালিক মো. হামজালাল শেখ, মো. শামিম আহম্মেদ, মো. রাসেল আহম্মেদ ও ফেরদৌস হাসান, লঞ্চের ইনচার্জ মাস্টার মো. রিয়াজ সিকদার, ইনচার্জ চালক মো. মাসুম বিল্লাহ, দ্বিতীয় মাস্টার মো. খলিলুর রহমান ও দ্বিতীয় চালক আবুল কালাম।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্ধ হাফেজ মিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি অসুস্থ বাবাকে চিকিৎসা শেষে ওই লঞ্চে সেদিন ফিরছিলাম বরগুনায়। আমার সাথে মা,আমার স্ত্রী ও সন্তান ছিল। কিন্তু অসুস্থ বাবাকে নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারলাম না। বাবার মরদেহ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাবার লাশটাও যদি পেতাম তবুও সান্ত্বনা পেতাম। লঞ্চের সেই ঘটনা মনে হলে এখনো ভয় লাগে।

অভিযান ১০ ট্রাজেডিতে নিহত হাকিম শরিফ (৪৫) এর মা রতন বিবি জানান, ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তার ছেলে। বাড়ি ফেরার সময় অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্ত্রী পাখি বেগম আর ১৬ মাস বয়সের শিশু সন্তান নাসরুল্লাহসহ নিহত হন হাকিম শরীফ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে সহ ৩ জনকে হারিয়ে এখনো নির্বাক রতনবিবি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাদের কোন হদিস মেলেনি। পরে ডিএনএ টেস্টের ফলাফলে শনাক্ত হয় এই তিনজনের মরদেহ। কিন্তু ডিএনএ টেস্টের ফলাফল প্রকাশের আট মাস পর এখনও বুঝিয়ে দেয়া হয়নি তাদের কবর।

পোটকাখালি গণকবর এলাকার বাসিন্দা মজিবুর রহমান জানান, প্রায় ১ বছর ধরে আমি গণকবরের পাশ দিয়ে যাতায়াত করে আসছি। কিন্তু কাউকে কখন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে ও দেখিনি। গত বছর প্রশাসনের লোক-জন যেভাবে দাফন করে গিয়েছে, সেভাবেই পড়ে আছে। দু-একটা কবরের পাশে রাখা সাইন্ডবোর্ড গুলো নিচে পড়ে গেছে। পাশাপাশি দেয়াল টির অবস্থাও ভালো নয়। প্রশাসনের কাউকেই কখনো নজরদারী-তে দেখিনি। তাই এখানে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন মানুষ রাখা প্রয়োজন।

বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, খুব শিঘ্রই ডিএনএ পরিক্ষায় শনাক্ত হওয়া মরদেহের কবরগুলো আদালতের মাধ্যমে স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হবে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ৩০ যাত্রীর মধ্যে ১৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এই ১৪ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার জন্য আমরা নৌ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। যে কোনো সময় মন্ত্রণালয় থেকে ভুক্তভোগী সকল পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া কোন পরিবার স্বজনের কবর বুঝে নিতে চাইলে আবেদন করার কথাও জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান।

উল্লেখ্য, ঢাকা সদরঘাট থেকে ছয় শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনার উদ্দেশে ছেড়ে যায় অভিযান-১০ লঞ্চ। ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর দিবাগত রাত ৩ টার দিকে লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর মোহনায় এলে ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয়ে পুরো লঞ্চে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নদীতে লঞ্চটি জ্বলছিল। পরে সেটি ভাসতে ভাসতে দিয়াকুলের চরে এসে আটকা পড়ে। জীবন বাঁচাতে অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনায় ৪৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে পরিচয় সনাক্ত না হওয়ায় ২৩ জনের মরদেহ বরগুনার পোটকাখালি গণকবরে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে পরিচয় মেলায় ৮ জনের মরদেহ তাদের পরিবার নিয়ে যায়। বাকি মৃত ১৬ জনের পরিচয় শনাক্তের জন্য ৫১ জন স্বজন ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন। কিন্তু এক বছর পূর্ণ হলেও শনাক্ত হয়নি মৃত ১৬ জনের পরিচয়।

সংশ্লিষ্ট খবরগুলো

চাইলে পড়তে পারেন
Close
Back to top button